ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করে আমেরিকার ভার্জিনিয়াতে ফেয়ার ওকস মল, ফেয়ারফ্যাক্স, ভার্জিনিয়াতে ঘুরতে ঘুরতে একটা এক ঘন্টা স্টুডিওতে ছবি তোলার জন্য ফটোগ্রাফার এবং দক্ষ ল্যাব টেকনিশিয়ান দরকার হওয়ার খবর পাই স্টুডিওর দরজায়। জব এপ্লিকেশন ফর্ম থেকে ফটোগ্রাফি এবং ল্যাবে অভিজ্ঞতা দেখে অন দ্যা স্পট আমাকে হায়ার করা হয়। কিন্তু বেতন ছিল খুব কম। ঘন্টায় ৫ ডলার। তারপর এর থেকে প্রায় ৩৫% ট্যাক্স, FICA, ফেডারেল ট্যাক্স মানে সবমিলিয়ে ৫ ডলারের চেয়েও কম হয় ঘন্টায়। যে কাউন্টিতে থাকতাম (ফেয়ারফ্যাক্স যা আমেরিকার সবচেয়ে ব্যয়বহুল কাউন্টি) এই পয়সা দিয়ে এপার্টমেন্ট ভাড়া এবং অন্যান্য খরচ বহন করা সম্ভব না। কিন্তু সব ভুলে মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে থাকলাম। এরপর কয়েক সপ্তাহ পর ওয়াশিংটন পোস্টে হঠাৎ সাহায্য প্রয়োজন সেকশনে চোখে পড়লো একজন পেজ এসেম্বলার দরকার, সেই সময় যার নাম ছিল স্ট্রিপার। প্রসেস ক্যামেরা, কালার থেরাপি, ড্রাম স্ক্যানিং ইত্যাদিতে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। ন্যূনতম ৫ বছরের অভিজ্ঞতা লাগবে, কোম্পানিটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইমেজ ম্যানিপুলেশন এবং প্রিপেস কোম্পানি কিন্তু আমি পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা লাগবে দেখে চুপসিয়ে গেলাম যেহেতু আমার কোন অভিজ্ঞতা নেই সরাসরি কোন কোম্পানির প্রোডাকশন পরিবেশে কাজ করা সম্পর্কে। কিন্তু আমি হাল ছাড়লাম না। আমি গিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইমেজ ম্যানিপুলেশন কোম্পানি ওয়াশিংটন ডিসিতে এপ্লাই করি। কিন্তু এপ্লিকেশনে সব সত্যি কথা লিখি। তিনদিন পরে ডাক আসে কিন্তু অভিজ্ঞতা প্রশ্নে আটকে যাই কিন্তু আমি ওদের আটকাতে দিবোনা। আমি বললাম আমার পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা নাই কিন্তু একি কাজ ইউনিভার্সিটিতে শিখেছি প্রত্যেকটা সাবজেক্ট এ ১০০% মার্ক পেয়েছি কালার সেপারেশন, কালার থেরাপি, প্রসেস ক্যামেরা, পেজ এসেম্বলি, স্ট্রিপিং ইত্যাদি। আমাকে সুযোগ দিলে আমি দেখিয়ে দিবো এ কাজ আমার পক্ষে সম্ভব। আবার দুইদিন পর ডেকে আমাকে জিজ্ঞেস করলো যদি আমি কাজ না পারি তখন কি হবে? আমি উত্তর দিই- আমাকে বের করে দিবেন। আমি একটা কথাও বলবো না। আবার তিনদিন পর ডাকলো এবং আমাকে তিনটা কাভারের কাজ দেয়া হয় Time, Newsweek এবং National Geographic এর । কিন্তু আল্লাহ্‌র অশেষ রহমত ১৫০টা ম্যাগাজিনের মধ্যে এই তিনটার কাজই ছিল সোজা । আমি ৮ ঘন্টার মধ্যে তিনটা কাভার সাবমিট করি এক এক করে । কিন্তু কেউ বললো না কেমন করলাম। পরে জানাবে শুধু এটাই বললো। পরদিন আমার ডাক পড়লো। অনেক কাগজপত্র সাইন করে কাজ শুরু করি ১ তারিখ থেকে। ঘন্টায় ৫ ডলার থেকে আমার বেতন হয়ে গেলো ঘন্টায় ২৫ ডলার। ৮০র দশকে এটা অনেক টাকা ছিল।

আমার যে পজিশন সেটায় সবচেয়ে ট্যালেন্টেড এবং স্মার্ট লোকদের নেয়া হয় সেম ইন্ডাস্ট্রি থেকে কারণ কাজগুলি সবচেয়ে প্রেস্টিজিয়াস এবং সেই সময় সব ক্লায়েন্টদের সঙ্গে এক ঘন্টায় ডেলিভারি দিতে দেরী হলে ঘন্টায় ১০,০০০ ডলার জরিমানার কন্ট্র্যাক্ট ছিল সব কাস্টমারের সাথে । কাজেই সবচেয়ে দায়িত্ববান এবং অভিজ্ঞ লোকদের হায়ার করা হতো মিনিমাম পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন । আমি প্রমাণ করে দিয়েছি ডেডিকেশন, একাগ্রতা এবং ভিশন দিয়ে চেষ্টা করলে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায় । আমার এপার্টমেন্ট থেকে শুরু করে যা যা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস লাগে সব চাহিদা পূরণ করলাম । Color Experts International or Clipping Path India শুরু করার আগে আমি ১৯৮৫ সালে আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইমেজ ম্যানিপুলেশন এবং প্রিপেস কোম্পানিতে কাজ করা শুরু করি যারা বিশ্বের সবচেয়ে অভিজাত প্রকাশনায় জড়িত ছিল। কোম্পানির মধ্যে ছিল Newsweek, Time, National Geographic, Smithsonian, Vanity Fair, US News and World Report, The National Journal, National Review, The New Republic, etc.

বেশকিছু বছর অভিজ্ঞতা অর্জনের পর যেহেতু সপ্তাহে তিনদিন ১২ ঘন্টা করে কাজ করতাম প্রত্যেক সপ্তাহে ৪ দিন ছুটি। অনুমতি নিয়ে বেঙ্গল গ্রাফিক্স (কোম্পানির লোগো বাংলাদেশী বাঘের মুখ) এবং 3PI (Prepress, Publishing & Printing International) শুরু করি যা আমেরিকার মধ্যে ১৭তম ইমেজ ম্যানিপুলেশন কোম্পানি হয়ে যায়। আমাদের গ্রাহক ছিল RR Donnelley (the biggest printing company in the world), Nation’s Business Magazine (the most circulated Business Magazine in the world for US Chamber of Commerce), Washingtonian Magazine, Rolls Royce ইত্যাদি । বিভিন্ন প্রিন্টিং এবং প্রকাশনা সম্পর্কিত ম্যাগাজিনে কোম্পানি ফিচারড হয় । আমি বাবাকে জোর দিলাম, বাবাও কালার সেন্টার (নাম Charleston, West Virginia, USA) বিজনেস শুরু করলেন । আমি ভার্জিনিয়া থেকে প্রচুর কালার সেপারেশন কাজ দিলাম কোম্পানি সফল করানোর জন্য । আমার মার্কেটিং, ডিজিটাল স্টুডিও ভার এবং বাবার ডিটিপি এবং হাই এন্ড কালার সেপারেশন ভার নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি ব্যবসা করে বাংলাদেশে কালার সেন্টার এবং সর্ব প্রথম হাই এন্ড ডিজিটাল স্টুডিও সেটআপ করে কালার সেন্টার খুব নাম করে বাংলাদেশে ।

জীবনে অনেক বাধা আসে এবং এই বাধাগুলি আশীর্বাদ হয়ে কাজ করে। ভেঙে পড়া যাবেনা কারণ প্রতিটা বাধা-বিপত্তির যাওয়ার পেছনে অনেকগুলো সুযোগ লুকিয়ে থাকে। আমি যখনি বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতাম বা হতাশ হয়ে যেতাম আমি চিন্তা করতাম ১৯৭১ এ কিভাবে অত্যাচারিত মহিলাদের কেউ ফিরিয়ে নিতোনা। বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী কেউই না। কিন্তু তাদের কোন দোষ ছিলোনা। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে টর্চার করতো তাদের সারা জীবন কিভাবে কেটেছে যখন আমি জানতে পারি, আমার সমস্যার সাথে তুলনা করলে সেসব কোন সমস্যাই মনে হতোনা। অনেক ফর্মুলার মধ্যে এই একটা ফর্মুলা ইউজ করতাম হতাশা থেকে বের হয়ে আসতে।

১৯৭১ এ মেয়েরা যেভাবে নির্যাতিত হয়েছে ওরকম এসিড ভিক্টিম দেখেছি আমি বর্তমান সময়ে। এটা ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি। এসিড ভিক্টিমের মুখগুলো আকার-আকৃতি হারিয়ে ফেলে, দেখতে খুব বাজে লাগে। তাদের আপনজন এমনকি বাবা-মাও তাদের নিতে চায়না কারণ এটা সমাজে তাদের অবস্থান ক্ষুণ্ণ করে। তাদের এ দুর্দশা, কষ্টের ব্যাপারগুলো আমাকে শেখায় কতটা ভাল অবস্থানে, ভাল অবস্থায় আমি আছি। তাই তাদের জন্য কিছু করতে পারাটা আমাকে এক ধরণের স্বস্তি দেয়।

আমার বাবা বিশ্বে প্রথম কালার সেপারেশন এর উপর বই লিখেন। পিএইচডি করেছেন কালার সেপারেশনের উপর। বিশ্বে এই লাইনের সবাই বাবাকে এক নামে চিনে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস উনি অনেক ভাল কাজ করেছিলেন যেমন স্বাধীনতার পরে স্কুল টেক্সটবুক ফ্রি দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন, কাভার গুলি নিজের হাতে করেছিলেন, প্রচুর ছাত্রছাত্রীদের গ্রাফিক আর্ট ইন্সটিউট সহ আমেরিকার West Virginia University Institute of Technology তে ভর্তির ব্যবস্থা করেছিলেন প্রফেসর যখন ছিলেন। যারা পড়াশোনা করে ভালভাবে নিজের পায়ে দাড়িয়েছে। আমি মনে করি ভাল কাজ করলে আল্লাহ্‌ তার বদলে ভাল করার সুযোগ দেয়। আমি এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী এবং সারা জীবন বিশ্বাস করে যাবো।

2018-06-22T23:24:14+06:00