আমি আমাদের গ্রুপ অফ কোম্পানির লোকদের হায়ার করি বেশীরভাগ রিমোটলি। বাংলাদেশে দুই একদিনের জন্য গেলে এবং এপ্লিকেন্ট থাকলে কিছু হায়ারিং হয় এবং একবার এক মেয়ের জব এপ্লিকেশন, সিভি চেক করার পর কথা হয়েছিল এবং প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল। ফাইনালি ওকে জিজ্ঞেস করলাম তুমি এখানে মডেল এর জন্য জব ইন্টারভিও দিতে আসোনি তাহলে এত সুন্দর কাপড়চোপড়, এত মেকআপ কেন? ক্যান্ডিডেট ভাবছিল এটা আবার কেমন প্রশ্ন? মেয়েটা সাহস করে পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে বলতে চাইলো। ব্যাপারটা হলো বাংলাদেশে বেশিরভাগ জব ইন্টারভিওর ক্ষেত্রে সুন্দরী দেখলেই হায়ার করে, কাজ দেখে না। কাজেই সব মেয়ের সেজেগুজে ইন্টারভিও দিতে যায়। এটা এক ধরণের ট্রেন্ড হয়ে গেছে ইন্টারভিওর ক্ষেত্রে। আমি বললাম বিজনেস করতে গেলে তো দক্ষ জনবল লাগবে, কোন ধরণের কোয়ালিফিকেশন ছাড়া শুধু সৌন্দর্য দিয়ে কিভাবে কাজ চলবে? যদিও মেকআপ এবং কাপড়চোপড় সম্পর্কে সত্য উত্তর দেয়ায় ওকে কোন পেনালাইজ করা হয়নি বরং ওকে হায়ার করা হয়।

বাংলাদেশের মেয়েদের বৈষম্যের সমস্যা শুরু হয় নিজ বাসা থেকে। বেশীরভাগ সময়ই (প্রায় ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে যেটা আমার একটা এস্টিমেশন) মেয়েদের দাবিয়ে রাখা হয়। ছেলেরা সবকিছুতে অগ্রাধিকার পায় যেমন ভাল খাওয়া, বড় মুরগীর রান, মাছের মাথা ইত্যাদি। বাসায় কোন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হলে ছেলেদের মতামতকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। এই যে মেয়েদের দাবিয়ে রাখার ব্যাপার সেটা রাস্তাঘাটে, অফিসের কাজে রিফ্লেক্ট হয়। এই যে কোম্পানির রেসপন্সিবল ব্যক্তিরা এর সুযোগ নিচ্ছে তার জন্যও কিন্তু মেয়েদের ফ্যামিলিই দায়ী। কারণ মেয়েদের এক প্রকার বাধ্য করা হয় ছেলেদের জন্য স্যাক্রিফাইস করতে ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ছেলেরা খারাপের দিকে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত মেয়েদের উপর বৈষম্যের কারণে। বাংলাদেশের মেয়েরা কি সত্যি বোকা? তারা কি দাবিয়ে রাখার মত? আমি ১৯৭৬ সালে আমেরিকা চলে যাই। যাওয়ার আগ পর্যন্ত যে এক্সপেরিয়েন্স সেটাই বাংলাদেশ নিয়ে আমার সবচেয়ে বেশী এক্সপেরিয়েন্স। বাংলাদেশে যখন ছিলাম তখন আমার খেলার সাথীর প্রায় অর্ধেকই ছিল মেয়ে। ছেলেরা কখনো মাতবরী করেনি বরং আমরা একসাথে খেলেছি এবং সম্মিলিতভাবে সকল সিদ্ধান্ত নিতাম। আমেরিকা গিয়ে দেখেছি ছেলে মেয়ে বলে কোন পার্থক্য নেই। বাংলাদেশের মেয়েরা যদি বোকাই হবে তাহলে দেশের প্রধানমন্ত্রী মহিলা হলো কিভাবে?

আমি আজ যেখানে এসেছি তার পিছনে মূল অবদানও এই মেয়েরই। আমার মেয়ে এবং আমার স্ত্রী। তারা যদি আমাকে আগলে না রাখতো তাহলে এই পর্যায়ে কিছুতেই পৌঁছুতে পারতাম না। আমার তাদের উপর বিশ্বাস ছিল। আমার সফলতার পেছনে তাদের ১০০ ভাগ অবদান রয়েছে। আমার মেয়ে আমেরিকা থেকে পড়ে দুবাইয়ে থাকাকালীন সময়ে প্রত্যেক গ্রীষ্মে বাংলাদেশে যেত এসিড ভিক্টিমদের নিয়ে কাজ করার জন্য। কয়জন ছেলে এটা করে? এসিড ভিক্টিমদের কাহিনী শুনতে শুনতে ও শেষমেশ ল’ইয়ার হতে চেয়েছে এসিড নিক্ষেপকারীদের জেলে ঢুকানোর জন্যে। আজ সে লন্ডনের একজন সফল ছাত্রী এবং এখন ল’ইয়ার। রানা প্লাজা মালিকদের বিরুদ্ধে যেই ল’ ফার্মটা কেস করেছিল সেটাতে সে ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করেছিল এবং কেসটা জিতেছিল। শুধু ল’ না ইংলিশেও ডাবল মেজর করেছে সে যাতে করে ভাল করে কমিউনিকেট করতে পারে। জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে। এখন আমরা বলবো প্রত্যেক ঘরে ঘরে এমন বৈষম্যের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য। কারণ এই সমস্যা বাংলাদেশের না, সমস্যা আমাদের এবং তোমাদের। মা দিবসে কত কমার্শিয়াল ব্যাপারস্যাপার করি কিন্তু ফ্যামিলিতে আবার বৈষম্য থাকে। আমার স্ত্রী, আমার মেয়ে আমাকে ঠিক রাস্তায় নিয়ে গেছে কারণ তাদের উপর আমার পুরোপুরি বিশ্বাস ছিল এবং আছে, থাকবে। একইভাবে বাবা, ভাইরা যদি বাংলাদেশের মেয়েদের আর একটু দাম দিতো তাহলে তাদের লাইফ আরেকটু ভাল হতো। পুরা বাংলাদেশকে ঠিক করার দরকার নেই যেটা মুহুর্তের মধ্যে সম্ভবও না। শুরুটা আমাদের নিজেদের ফ্যামিলি থেকেই হোক। আপাতত সে চেষ্টা করলেই হবে।

2018-06-22T23:46:44+06:00