বিক্রয়ের (Sales) উপর অনেক বই লেখা হয়েছে। ইতিমধ্যে, বহুজন বহু নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা করেছেন, এখনও করছেন। বহু নামজাদা ব্যক্তিত্ব বিশ্ব জুড়ে বিভিন্নি সেমিনার-সমাবেশ করে আলোচনা করেছেন এই বিক্রয়ের (Sales) উপর।

আমি নিজের ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতা আপনাদের সাথে শেয়ার করবো।

আমেরিকাতে ১৯৭৬ সালে আমি খুব ছোটো পরিসরে এই বিক্রয় (Sales) এবং বাজারজাতকরণ (Marketing) শুরু করি।

আমি বাড়ি বাড়ি পত্রিকা (newspaper) ডেলিভারী দিতাম। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা উপার্জন হতো না, মাত্র ১৫০ কপি পত্রিকা (newspaper) বিলি করে।

তখন বুঝলাম, আয় বাড়াতে হলে বিক্রির হার বাড়াতে হবে। কিন্তু অন্যান্য সড়ক/রাস্তায় অন্য ছেলেরা পেপার বিলি করছে। কাজেই, আমার বাড়তি (Extra) কাস্টমার পাওয়া কিছুটা মুশকিল।

উপার্জন বাড়ানোর চিন্তায় আমি একটা বুদ্ধি বের করলাম। আমি বাড়তি কাগজ কিনতে শুরু করলাম! অনেক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েও আমি প্রত্যেক ৫ বাড়ি পর পর একটা করে ফ্রি পত্রিকা (newspaper) বিলি করতে থাকলাম।

এক পর্যায়ে আমার গ্রাহক সংখ্যা ১৫০ থেকে ৩৫০ হয়ে গেলো! সব খরচ বাদ দিয়ে মাসের শেষে আমার $50.00 (পঞ্চাশ) ডলার করে লাভ (profit) আসতে শুরু করলো। আমি তো মহা খুশি তখন। আমার খুশিটা কিন্তু $50.00 (পঞ্চাশ) ডলারের জন্য না। আমি খুশি কারণ ঋণাত্মক মান থেকে আমি উঠে আসতে পেরেছি, সব খরচ বাদ দিয়ে আমার $50.00 (পঞ্চাশ) ডলার মুনাফা হচ্ছে।

মুনাফা যত কমই হোক না কেন, খুশি হওয়া/গুরুত্ব দেয়াটা জরুরী। কারণ এই ছোট ধাপটি পরবর্তীতে আরো অনেক বড় বিনিয়োগের উৎসাহ যোগায়।

আমি জানতাম না খবরের কাগজ কিনে বিক্রি করাটা একটা ব্যবসা! ৫টা বাসার পর পর একটা ফ্রি খবরের কাগজ দেয়া, ১৫০ থেকে ৩৫০ কপি হওয়াটা Business Development অথবা বিক্রয় (Sales) এবং বাজারজাতকরণ (Marketing)।

এরপর আমি কয়েকদিন ওই ফ্রি গ্রাহকদের বাড়ির আশে-পাশে ঘুরতে থাকলাম। যখন ওদের কেউ বাসা থেকে হতো, আমি বলতাম, ফ্রি কাগজ কেমন লাগছে? কাগজগুলো আমি বিলি করছি। ২/১ মিনিট কথা বলার পর তাদের অনেকেই আমাকে রেগুলার কাগজ দেয়ার অর্ডার দিতে লাগলো।

৭০ দশকের সেই ফ্রি কাগজ বিলি, বিক্রয় (Sales) এবং বাজারজাতকরণ (Marketing) অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে ৮০’র দশকে আমি ব্যবসায় নামি। প্রতিষ্ঠানের নাম দেই বেঙল গ্রাফিক্স । তৎকালীন সময়, R.R. Donnelley নামে একটি প্রিন্টিং ব্যবসায় চালু ছিলো, যা পরবর্তীতে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ প্রিন্টিং কোম্পানির মর্যাদায় ভূষিত হয়। এটা গর্বের কথা তারা আমাদের গ্রাহক ছিলেন। আরো আমাদের গ্রাহক ছিলেন, Nation’s Business Magazine

(আমেরিকার সবচেয়ে বহুল প্রচারিত বিজনেস ম্যাগাজিন), চেম্বার অব কমার্স, ওয়াশিংটনিয়ান ম্যাগাজিন, রোলস রয়েস কোম্পানি সহ বিশ্বের আরো মর্যাদাপূর্ণ কোম্পানির সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য হয়। ধীরে ধীরে বেঙল গ্রাফিক্স আমেরিকার ১৭তম বৃহৎ ইমেজ ম্যানিপুলেশন এবং প্রি-প্রেস কোম্পানির মর্যাদায় ভূষিত হয়।

বাংলাদেশে জন্ম নেয়া একটি ছেলের পক্ষে এর চেয়ে বেশি বিস্ময়কর/সুখকর অনুভূতি কি হতে পারে?

আমি আমার বিক্রয়ের (Sales) অভিজ্ঞতা একটু একটু করে শেয়ার করবো। শেকড়ের টানে এবং সবাইকে অনুপ্রাণিত করতে আমি অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। দেশের জন্য কিছু করতে চাই।

আমার স্টাইলে, sales means no sales!

সবাই বিক্রয় (Sales) করছে, আমি বিক্রয় (Sales) করবো না।

পৃথিবীর সব দেশেই বিক্রয়ের (Sales) লোকদের কেউ পছন্দ করে না। কারণ তাদের একটা টার্গেট থাকে, যে কারণে সব সময় ক্রেতাদের তারা প্রেশারে দেয়।

আমি বিক্রয়ে (Sales) গেলে কোনো বিক্রয় (Sales) করি না, কোনো প্রেশার দেই না।

প্রত্যেক মিটিং এ প্রতিটা কাস্টমারকে বিভিন্নভাবে customize করতে হবে। আমি তাদের সাথে টুকটাক কথা বলি, যেমনঃ কেমন আছেন? পরিবার কেমন আছে? ১৫ কি ২০ মিনিট পর বলি, এবার আসি তাহলে। তখনই কাস্টমার বলে, কালকে অর্ডার কনফার্ম করা হবে। হাসি দিয়ে থ্যাংক ইয়ু বলে বেরিয়ে পড়ি।

কাস্টমারের সংগে বিক্রয় (Sales) করতে হলে মিটিং করা আবশ্যক। কোনো মাসে একবার অথবা তিন মাসে একবার, যা সম্পূর্ণ নির্ভর করবে কাস্টমারের উপর। মিটিং ঠিক করার পর সবচেয়ে প্রথম কাজ, নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হবে যেন মিটিং স্থলে ২ মিনিট দেরী না করে ২০মিনিট আগে পৌছাতে পারি। আরো একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, কাস্টমারের কাছে কখনো মার্কেটের অন্য প্রতিযোগীদের নামে খারাপ কিছু বলা যাবে না।

৮০% সময় আমি ট্রাভেল করি। আমার প্রধান টার্গেট থাকে যেন ২০% কাস্টমারদের নিয়ে ৮০% ব্যবসায় generate করতে পারি।

এ পদ্ধতিটি আমি ইঙ্ক এবং ইমেজ ম্যানিপুলেশন দু’জায়গাতেই অবলম্বন করে আসছি।

যেই প্রশ্নগুলো আমাকে বেশি জিজ্ঞাসা করা হয়ে থাকে।

প্রশ্নঃ আমি কিভাবে ব্যবসায় শুরু করবো। এবং ব্যবসায় করার জন্য কি কি যোগ্যতা লাগে?

উত্তরঃ ব্যবসায় শুরু করার আগে মাথায় যেই জিনিসটি পিন দিয়ে সেঁটে রাখতে হবে, তা হলো,ব্যবসায় আমার জন্য না, আমার অনেক টাকা ইনভেষ্ট করা আছে, তার জন্যও না। ব্যবসায় আমার ১০০ জন কর্মচারীর জন্য। কারণ হচ্ছে, এই ১০০ জন কর্মচারীর ৫০০ পরিবার-পরিজন এই ব্যবসায়ের উপর নির্ভরশীল। আমার ব্যবসায়ের ইনকাম যেনো কোনোভাবে বন্ধ না হয়ে যায়, সেই খেয়াল রাখতে হবে।

এই ১০০জন কর্মচারীই কোম্পানির মুনাফা ৫% থেকে ৮০% করবে। কোম্পনির উন্নতি তাদের হাতে, ওদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার (বকা-ঝকা, চিল্লা-চিল্লি) করা যাবে না। যে কোনো ধরণের খারাপ ব্যবহার কোম্পানির জন্য হুমকির কারণ হতে পারে। কর্মচারীদের সঙ্গে বেষ্ট ফ্রেন্ডের চেয়েও অনেক গুণ বেশি ভালো ব্যবহার করতে হবে। বেষ্ট ফ্রেন্ড আমার ব্যবসার মুনাফা বাড়াবে না, কিন্তু এরা মুনাফা বাড়াতে পরিশ্রম করবে।

আমি আমার ইন্টারনাল মিটিং এ সব সময় বলি কোনো কর্মীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা যাবে না। এমনকি ম্যানেজারসহ আমরা যারা পরিচালনা পর্ষদে আছি তারাও কোনো কারণে কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারবে না। একটা কম্পিউটার চুরি হলেও এতটা ক্ষতির মুখে পড়তে হয়না, যতটা ক্ষতি হয় কোনো কর্মীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে। অর্থাৎ, আমি বলতে চাচ্ছি, একজন কম্পিউটার চোরের যা শাস্তি হওয়া দরকার, তারচেয়েও বেশি একজন খারাপ ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীর শাস্তি হওয়া উচিৎ। সাধারণত, খারাপ ব্যবহারের ফলে কর্মীর সারাদিন মন খারাপ থাকে, এতে করে কর্ম গতি হ্রাস পায়।

আমি প্রতিটি কর্মকর্তা/কর্মচারীকে (Top to Bottom) আমার ফোন নাম্বার দিয়ে রেখেছি, ওদের যেকোনো সুবিধা-অসুবিধা জানানোর জন্য। সব কর্মীদের সুবিধার্থে, ২৪ ঘন্টাই আমি মোবাইল ফোন চালু রাখি। অর্থাৎ, আমি বছরের ৩৬৫ দিনই কাজ করি আমার কর্মচারীদের জন্য, এতে আমার কোনো আক্ষেপ নেই বরং আমি খুশি। আমি সব সময় কর্মীদের বলি, আমি নয় বরং তোমরাই কোম্পানীর মালিক। তোমরা ছাড়া এই কোম্পানীর কোনো অস্তিত্ব নেই। প্রোডাকশনে ৮০% লোক কাজ করে এবং অন্য ডিপার্টমেন্টেও আমার এই পদ্ধতি অবলম্বন করে ৮০% পর্যন্ত ব্যবসায় বৃদ্ধি করেছি ।

সর্বশেষে বলতে চাই, আমি খুব সাধারণ মানুষ, কিছু অসাধারণ মানুষদের নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে আমার কোম্পানিগুলো চালাই। কিন্তু এ কথা না বললেই নয়, উপরওয়ালার সাহায্য ছাড়া এগুলো প্রায় অসম্ভব ছিলো। আমি কখনো কোনো কর্মীকে পারিশ্রমিক কম দেইনি বরং বেশি দেয়ার চেষ্টা করেছি। কারণ, আমি মনে করি উপরওয়ালা আমাকে এই তৌফিক দান করেছেন।

তো এই ছিলো আমার বিক্রয় (Sales), বাজারজাতকরণ (Marketing), কর্ম প্রক্রিয়া (Operations), ব্যবস্থাপনার (Management) সাধারণ পদ্ধতিসমূহ।

আলহামদুলিল্লাহ! বিশ্বব্যাপী বহু দেশের বহু লোকেদের সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে আমার। কিন্তু সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশের মানুষদের সঙ্গে কাজ করে তৃপ্তি পেয়েছি আমি। আমি মনে করি,তারা আমার প্রিয় মানুষ। খুব সৎ এবং পরিশ্রমী বাঙ্গালীরা।

বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে মাতৃভাষার জন্য নিজেদের উৎসর্গ করতেও কেউ দ্বিধা পর্যন্ত করেনি। দেশের জন্য, ভাষার জন্য যারা এত কিছু করেছেন তাদের পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে আমাদের দায়িত্ব দেশটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া। ভাষার প্রতি বাংলাদেশের মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও গভীর অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে যেখানেই পারি বাংলা শব্দ/ভাষার ব্যবহার করি।

আশা করি আমার এই বিক্রয় (Sales), বাজারজাতকরণ (Marketing), কর্ম প্রক্রিয়া (Operations), ব্যবস্থাপনা (Management) নিয়ে সাধারণ উপস্থাপনটি সবাই বুঝতে পারবেন।

সবাই ভালো থাকবেন।

আরো আসছে পরে।

2018-06-06T22:33:35+06:00